বন্যা: পানি নামলেও দুর্ভোগ কমেনি, ভেসে উঠছে সড়ক জনপদের ক্ষতচিহ্ন - BBC News বাংলা (2024)

বন্যা: পানি নামলেও দুর্ভোগ কমেনি, ভেসে উঠছে সড়ক জনপদের ক্ষতচিহ্ন - BBC News বাংলা (1)

ছবির উৎস, Getty Images

Article information
  • Author, সানজানা চৌধুরী
  • Role, বিবিসি নিউজ বাংলা

“ঘরে একটু চাল নাই, চাল যে পাকাবো ওই হাড়ি চুলা কিছুই নাই। ল্যাট্রিন ভেসে গেছে। এই ভিজা কাপড় নিয়ে আছি আজকে সাতদিন। আমার ঘরের সব ভাসায় নিয়ে গেছে।”

নিষ্পৃহ কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার মোমারিজপুর গ্রামের বাসিন্দা তাহেরা বেগম।

সত্তরোর্ধ্ব এই নারী পরিবারের আরও চার সদস্য নিয়ে থাকতেন ছনের ছাদ দেয়া মাটির বাড়িতে।

ফেনীতে যখন বন্যা হানা দেয় প্রথম ধাক্কাতেই তার গ্রাম ভেসে বিলীন হয়ে যায়। তাহেরা বেগম আর তার পরিবার কোনও রকমে স্থানীয়দের সহায়তায় পাশের একটি মাদ্রাসায় আশ্রয় নেন।

এখন পানি কমার পর তিনি বাড়ি ফিরেছেন ঠিকই, কিন্তু ওই বাড়িতে থাকার মতো অবস্থা নেই। ঘরের মাটির মেঝে নরম হয়ে পা ডুবে যাচ্ছে। ছাদ আর দেওয়াল ছাড়া কিছুই নেই। ঘরে ফিরেও ঘর পাওয়া হয়নি তার।

অবস্থাপন্ন অনেক পরিবারও বন্যার কারণে হয়েছেন ঘরছাড়া।

ফেনী সদর উপজেলার বাসিন্দা নাহিদা আঞ্জুমান পাঁচ তলা ভবনের নিচতলায় থাকতেন তার পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে।

কিন্তু বন্যার পর থেকে তাদের সবার ঠাঁই হয়েছে দোতলায় প্রতিবেশীর বাসায়। এবারের বন্যায় ২৪ ঘণ্টার মাথায় তাদের একতলার বাসা প্রায় ছাদ অবধি ডুবে যায়। এখন বন্যার পানি ধীরে ধীরে নামতে শুরু করলেও ঘরে ফেরার কোনও অবস্থা নেই।

বন্যার পানি বৃদ্ধি এত আকস্মিক ছিল যে অধিকাংশ পরিবার ঘরের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরানোর সুযোগও পায়নি।

“পানি এতো দ্রুত বেড়েছে এক কাপড়ে বের হয়ে আসছি। আমার সব ফার্নিচার নষ্ট হয়ে গিয়েছে। টিভি আর জরুরি কিছু কাগজ কোনওভাবে উপরে এনেছি। ফ্রিজটা আনতে পারি নাই। আলমারির কাপড়-চোপড়, বিছানা-বালিশ, বই খাতা সব ভেসে গিয়েছে।”

“এখন বাসা ভর্তি শুধু কাদা, ময়লা-আবর্জনা। আমরা জাস্ট জিরো হয়ে গিয়েছি,” বলতে বলতে কণ্ঠরোধ হয়ে আসছিল তার।

আরও পড়তে পারেন
  • বন্যার বিষয়ে আগে থেকে কেন বাংলাদেশ প্রস্তুতি নিতে পারলো না?

  • ডম্বুর বাঁধে ঠিক কী হয়েছে?

  • 'উড়ন্ত নদীর' কারণে বিশ্ব জুড়ে দেখা দিচ্ছে আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধস

বন্যা: পানি নামলেও দুর্ভোগ কমেনি, ভেসে উঠছে সড়ক জনপদের ক্ষতচিহ্ন - BBC News বাংলা (2)

ছবির উৎস, Getty Images

এদিকে, কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলায় গত দুইদিন কোনও বৃষ্টিপাত না হলেও এখনও সেখানকার জনপদ, বিশেষ করে বাকশীমুল, হরিপুর ও যদুপুর ইউনিয়ন পানিতে ডুবে আছে।

কুমিল্লা জেলা সদরের আশেপাশের দেড় কিলোমিটার এলাকাগুলোয় পানি সম্পূর্ণ নেমে গেলেও জীবন সেখানে এখনও ছন্নছাড়া।

জেলা সড়কের অধিকাংশ অংশ কংক্রিটের স্তর সরে ভেঙে গিয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে সেখানে কোনও অটোরিক্সা চলার অবস্থা নেই। আরো খারাপ অবস্থা গ্রামের ভেতরে ছোট অলিগলি ও কাঁচা সড়কগুলোতে।

এমন অবস্থায় কুমিল্লার বন্যাপীড়িত অনেক গ্রাম এখন বলতে গেলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। স্বেচ্ছাসেবীদের কোনও যান সেখানে ঢুকতে পারছে না।

স্থানীয় বাসিন্দা আরিফুর রহমান জানান, “রাস্তাঘাট একদমই ব্যবহার উপযোগী নাই। তার মধ্যে সন্ধ্যা হলেই ওই রাস্তায় কেউ চলতেও ভয় পায়। বন্যার পর থেকে প্রতিদিন আমি শুনি মসজিদ থেকে মাইকিং হয়, সড়কে অপরিচিত মানুষের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। স্থানীয়রা সতর্ক থাকুন। চিন্তা করেন, আমরা কতোটা অনিরাপদ আছি।”

বন্যায় ছোট-বড় সড়কগুলো যে ক্ষতির মুখে পড়েছে সেগুলো মেরামতে সরকারি, বেসরকারি প্রতিটি পর্যায় থেকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় আছেন মাছের ব্যবসায়ীরাও। কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের বহু মাছ চাষি ও খামারি একদম নিঃস্ব হয়ে গিয়েছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন জানান, “আমাদের এখানে প্রচুর মাছের ঘের ছিল। এবারে বন্যার পানি এতো উঠেছে, এতো স্রোত, সব ভেসে গেছে। অনেক বড় চাষি আছেন, কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ, তাদের ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে। আর ছোট চাষি যারা ১০/১৫ লাখ টাকা খাটিয়েছেন তাদের এখন পথে বসার অবস্থা।”

বন্যা: পানি নামলেও দুর্ভোগ কমেনি, ভেসে উঠছে সড়ক জনপদের ক্ষতচিহ্ন - BBC News বাংলা (3)

ছবির উৎস, Getty Images

অন্যদিকে, অনেক মুরগির খামার বন্যায় ভেসে গিয়েছে। যাদের গবাদি পশু ছিল, বন্যার পানির কারণে তাদের অনেক গরুর খুরা রোগ দেখা দিতে শুরু করেছে।

“একে তো আমাদের এদিকে ত্রাণ বলতে গেলে আসছেই না। যতোটুকু বা আসে, সেখানে তো পশুখাদ্য নাই। ঘাস যে খাবে, ওইটাও তো পানির নিচে। গরুগুলা না খেয়ে আছে কয়েকদিন!” বলছিলেন ইসমাইল হোসেন।

কুমিল্লা সদরের একটি সেলুনে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন দুলাল চন্দ্র শীল। বন্যার কারণে পরিবার নিয়ে এখন তার ঠাঁই হয়েছে পাশের একটি স্কুল ভবনে। সেলুন বন্ধ থাকায় কোনও আয়-রোজগার নেই।

এবারের বন্যার ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে উঠবেন সেটা ভাবতেই দিশেহারা হয়ে পড়ছিলেন তিনি।

“পানি নামার পর প্রতিদিন একবার বাসা দেখে আসি। আমার যে ঘরে পাকা মেঝে, সেটা ফেটে গিয়েছে। আর মাটির মেঝেতে পা দেবে যাচ্ছে। ভিটে যে কোনও সময় ভেঙে পড়তে পারে। আমি দৈনিক তিনশ বা চারশ টাকায় কাজ করি। যে ক্ষতি হয়েছে এটা তো সারা জীবনেও ঠিক করতে পারব না। কেউ কী আশ্রয়ে থাকতে চায়?”

বন্যা কবলিত এলাকাগুলোয় বন্যার পানি যতো নামছে ততোই স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্ষয়ক্ষতির এমন অসংখ্য চিহ্ন। এই পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক রূপে ফিরবে সেই সদুত্তর নেই কারও কাছে।

পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান জানিয়েছেন তারা বিগত ৪০ বছরে এরকম বন্যা দেখেননি।

এবারে বন্যা প্রলম্বিত হয়েছে, ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে অনেক। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে মূল্যায়নের কথা জানিয়েছেন তিনি।

“পানি যখন নামতে থাকে তখন অবকাঠামো নষ্ট হওয়া, রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। আমরা অ্যাসেস করে বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে জানাচ্ছি, তারা তাদের মতো পরিকল্পনা করে ব্যবস্থা নেবেন। এক কথায় বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসনের কাজটা আমরা সমন্বয়ের ভিত্তিতেই করছি। সবার আগে সড়কগুলো চলাচলের উপযোগী করাই প্রধান লক্ষ্য,” জানান তিনি।

বন্যা: পানি নামলেও দুর্ভোগ কমেনি, ভেসে উঠছে সড়ক জনপদের ক্ষতচিহ্ন - BBC News বাংলা (4)

ছবির উৎস, Getty Images

তবে বন্যায় যারা বাড়িঘর হারিয়েছেন তাদেরকে মানবিক সহায়তা হিসেবে টিন এবং প্রতি বান্ডেল টিন বাবদ তিন হাজার করে টাকা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।

কিন্তু ক্ষয়ক্ষতির হিসেব করলে সরকারি এই সহায়তা বেশ নগণ্য বলেই মনে করেন স্থানীয়রা। এক্ষেত্রে তাদের বাড়িঘর মেরামতে বড় কোনও উদ্যোগের আভাসও পাওয়া যায়নি।

এছাড়া সড়ক সংস্কারের কাজও শুরু হবে পানি পুরোপুরি নেমে যাওয়ার পর। এমন অবস্থায় বন্যার মতো দুর্ভোগও প্রলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা স্থানীয়দের।

এদিকে বন্যাপীড়িত এলাকায় খাদ্য সংকট লাঘবে ত্রাণ সহায়তা অব্যাহত আছে। তবে দুর্গতরা জানিয়েছেন ত্রাণ সহায়তা বেশি পাচ্ছেন সড়কের পাশের ও সম্মুখ এলাকাগুলোর বাসিন্দারা। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকায় সহায়তা যাচ্ছে কম।

এমন অনেক স্থানেই এখন ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে। প্রশাসনের সমন্বয়হীনতায় ত্রাণ বিতরণে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে অনেকেরই অভিযোগ।

উল্লেখ্য গত এক সপ্তাহ আগে ভারী বর্ষণে ও উজানের পানিতে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার জেলা বন্যায় আক্রান্ত হয়। এসব জেলার ৭৩টি উপজেলা বন্যা প্লাবিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণের সর্বশেষ বার্তা অনুযায়ী দেশের সব নদীর পানি কমতে কমতে এখন বিপদসীমার নিচে নেমে এসেছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতি এখন ক্রমান্বয়ে উন্নতি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

তবে বন্যা কবলিত বেশিরভাগ এলাকা গত সাতদিন ধরই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকায় বানভাসি মানুষের ভোগান্তি এখনও কমেনি। সন্ধ্যা ঘনাতেই মানুষের প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায়।

বিবিসি বাংলায় আরও পড়ুন

বন্যা: পানি নামলেও দুর্ভোগ কমেনি, ভেসে উঠছে সড়ক জনপদের ক্ষতচিহ্ন - BBC News বাংলা (5)

ছবির উৎস, Getty Images

এ বিষয়ে গত সপ্তাহে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বন্যাকবলিত এলাকায় দুর্ঘটনা এড়াতে বিদ্যুতের লাইন বন্ধ রাখা হয়েছে।

ইতোমধ্যে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরি করা হয়েছে। পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের লাইন চালু করা হবে।

এদিকে বন্যা কবলিত এলাকায় পানিবাহিত নানা রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। স্থানীয় হাসপাতালগুলোয় ডায়রিয়া ও চর্মরোগ নিয়ে মানুষ হাসপাতালে আসছে বলে জানা গিয়েছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা।

বন্যা: পানি নামলেও দুর্ভোগ কমেনি, ভেসে উঠছে সড়ক জনপদের ক্ষতচিহ্ন - BBC News বাংলা (2024)
Top Articles
Latest Posts
Recommended Articles
Article information

Author: Nicola Considine CPA

Last Updated:

Views: 5443

Rating: 4.9 / 5 (69 voted)

Reviews: 92% of readers found this page helpful

Author information

Name: Nicola Considine CPA

Birthday: 1993-02-26

Address: 3809 Clinton Inlet, East Aleisha, UT 46318-2392

Phone: +2681424145499

Job: Government Technician

Hobby: Calligraphy, Lego building, Worldbuilding, Shooting, Bird watching, Shopping, Cooking

Introduction: My name is Nicola Considine CPA, I am a determined, witty, powerful, brainy, open, smiling, proud person who loves writing and wants to share my knowledge and understanding with you.